তাই বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, কেবলমাত্র প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার অভাবে স্বাস্থ্যকর্মীদের করোনা থেকে রক্ষা করা না গেলে দেশ ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়বে।
তারা বলছেন, এরইমধ্যে চারশোরও বেশি স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই চিকিৎসক। এছাড়া সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মঈন উদ্দিন রোগীদের সেবা দেয়ার সময় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনের (বিডিএফ) মতে, রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার সময় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে শুধু ঢাকাতেই ২৮৩ জন এবং অন্য ছয় বিভাগে ৯০ জন চিকিৎসক রবিবার পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
আরও পড়ুন: করোনা: শুধু ঢাকাতেই ২৮৩ চিকিৎসক আক্রান্ত, অন্য বিভাগে ৯০
ইউএনবির সাথে এ বিষয়ে আলাপকালে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া, ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ডা. ইকবাল আরসেনাল এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, সামনের সারির যোদ্ধা হিসেবে কার্যকরভাবে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদেরকে এই মুহূর্তে উচ্চমানের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম, সামাজিক সুরক্ষা এবং নিরাপদ থাকার ব্যবস্থা ও মানসম্পন্ন খাবার সরবরাহ করা প্রয়োজন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশিত সর্বশেষ স্বাস্থ্য বুলেটিন অনুযায়ী, দেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য মাত্র ৬ জন চিকিৎসক, নার্স এবং মিডওয়াইফ রয়েছেন।
অধ্যাপক কনক কান্তি বলেন, ‘এখনও চিকিৎসকদের স্ট্যান্ডার্ড গাউন এবং মাস্কসহ মানসম্পন্ন পিপিই সরবরাহ করা হচ্ছে না। চিকিৎসকরা করোনাভাইরাস থেকে নিজেদের রক্ষা করতে এন-৯৫ বা সমমানের কোনো মাস্ক পাননি। এর আগে তাদেরকে যে গাউনগুলো দেয়া হয়েছে তাও নিম্নমানের। নিম্নমানের এসব সরঞ্জাম ব্যবহার করে চিকিৎসকরা নিজেদেরকে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দিতে পারবেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে যা ন্যুব্জ হয়ে পড়া চিকিৎসা ব্যবস্থায় মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করছে। যদি আমরা আমাদের চিকিৎসকদের সুরক্ষা না দিতে পারি, করোনাভাইরাস মারাত্মক আকার ধারণ করলে তখন রোগীদের সেবা দেয়ার জন্য ডাক্তার এবং নার্সদের পাওয়ার সম্ভাবনা কম। আমাদের অবশ্যই সকল স্বাস্থ্যকর্মীকে মানসম্পন্ন প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে এবং তাদের নিরাপদ থাকার ব্যবস্থা ও মানসম্পন্ন খাবারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।’
তার হাসপাতালের কথা উল্লেখ করে বিএসএমএমইউ উপাচার্য বলেন, ‘৫০ বছর বা তার বেশি বয়সের চিকিৎসকদের এখন ডিউটি দেয়া ঝুঁকিপূর্ণ। নিরাপত্তার কথা ভেবে আমি তাদের দায়িত্ব থেকে দূরে রাখতে বাধ্য হচ্ছি। এছাড়া আমরা ৭-১০ দিন কাজ করার পরে কিছু চিকিৎসককে কোয়ারেন্টাইনে পাঠাতে বাধ্য। এ অবস্থায় যদি আমাদের কর্তব্যরত চিকিৎসকরা সংক্রমিত হন, তাহলে আমরা কীভাবে হাসপাতাল পরিচালনা করব এবং সাধারণ মানুষকে পরিষেবা দেব।’
অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, রোগীদের চিকিৎসার ইতিহাস এবং করোনাভাইরাসের লক্ষণগুলো লুকিয়ে রাখার প্রবণতাসহ অনেক কারণেই কিছু চিকিৎসক ও নার্সরা এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
তিনি বলেন, অনেক নার্স জনাকীর্ণ পরিবেশে পরিবারের একাধিক সদস্যের সাথে একসাথে বসবাস করেন এবং তারা গণপরিবহনের মাধ্যমে হাসপাতালে আসেন। এভাবে নার্সদের মাধ্যমেও অনেক চিকিৎসক ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন।
‘নার্সরা ভাইরাস থেকে নিজেকে রক্ষা করার বিষয়ে কম সচেতন,’ যোগ করেন তিনি।
অধ্যাপক খান আরও বলেন, ‘যাদের করোনার লক্ষণ রয়েছে তাদের পরীক্ষা করাতে হবে এবং এ চিকিৎসার জন্য মনোনীত হাসপাতালে যেতে হবে। খুব জরুরি না হলে কোনো দর্শনার্থী বা পরিচারককে কোনো হাসপাতালে প্রবেশের অনুমতি দেয়া উচিত নয়। সাধারণ মানুষ সামাজিক দূরত্ব এবং লকডাউনের নিয়মগুলো যথাযথভবে মানছেন না। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা কঠোরভাবে এটি প্রয়োগ করা উচিত।’
ঢামেক অধ্যক্ষ বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইতিমধ্যেই চিকিৎসক ও নার্সদের বাড়ীতে যাওয়ার অনুমতি না দিয়ে, ডিউটি শেষ হওয়ার পর সরকারের ব্যবস্থাপনায় থাকার বিষয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। এটি অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা উচিত। একজন ডাক্তার বা নার্সকে ৭-১০ দিন কাজ করার পরে অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে প্রেরণ করতে হবে। আমাদের স্বাস্থ্য কর্মীরা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে থাকলে সাধারণ মানুষেরা চিকিৎসা পাবেন না।’
ডা. ইকবাল আরসেনাল জানান, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল, চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং চিকিৎসা শিক্ষায় প্রায় এক লাখ নিবন্ধিত এমবিবিএস ও দাঁতের চিকিৎসক রয়েছেন। যাদের মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার চাকরিতে বা অনুশীলনে রয়েছেন এবং অন্যরা ব্যবসা বা অন্য কোনো কাজের সাথে জড়িত আছেন বা মারা গেছেন।
ডা. ইকবাল বলেন, ৭০ হাজার অনুশীলনকারী চিকিৎসকের মধ্যে প্রায় ৩০ হাজর বর্তমানে সরকারি সুযোগ-সুবিধায় কর্মরত এবং প্রায় ৩ হাজার চিকিৎসক প্রশাসনিক চাকরিতে জড়িত।
‘এমন পরিস্থিতিতে এটি অত্যন্ত ভীতিজনক যে, করোনায় আক্রান্ত ডাক্তারদের তালিকা আরও বড় হচ্ছে। এটিও উদ্বেগের বিষয় যে, বেশিরভাগ চিকিৎসক কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য মনোনীত হাসপাতাল থেকে ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন, যার বেশিরভাগই ঢকায়,’ যোগ করেন তিনি।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের এ সভাপতি বলেন, ‘চিকিৎসকদের আরও সাবধান হওয়া উচিত এবং রোগীদের কাছে যাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। মাস্ক ব্যবহারের পর তা কিভাবে নষ্ট করে ফেলতে হবে এবং কীভাবে নিরাপদে পিপিই ব্যবহার করতে হবে সেসব বিষয়ও তাদের জানা উচিত। আমাদের ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা না গেলে আমরা মারাত্মক পরিণতির মুখোমুখি হব।’
ডা. ইকবাল বলেন, প্রতিটি হাসপাতালের উচিত তাদের জায়গার একটি অংশকে রেড জোন এবং বাকিটি গ্রিন জোন হিসেবে ঘোষণা করা। সন্দেহজনক রোগীদের রেড জোনে প্রেরণ করতে হবে এবং তাদের দ্রুত কোভিড -১৯ পরীক্ষার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।’
ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, ‘রোগীদের চিকিৎসা করার সময় অনেক স্বাস্থ্যকর্মী, বেশিরভাগ চিকিৎসকই এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মূল কারণ হলো তাদেরকে মানসম্পন্ন পিপিই দেয়া হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘করোনার বিস্তার ঠেকাতে ১৫টি হাসপাতাল লকডাউন করে দেয়া হয়েছিল। এগুলো সত্যিই আমাদের জন্য খুব খারাপ সংবাদ। এখন আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের রক্ষার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালানো উচিত। অন্যথায়, করোনার পরিস্থিতি আরও অবনতি হলে আমরা একটি গুরুতর সমস্যার মুখোমুখি হব।’
‘আমাদের সকল মেডিকেল কলেজগুলোতে অনেক ইন্টার্ন এবং পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী রয়েছেন যাদের আমরা এখনই তাৎক্ষণিক প্রশিক্ষণ দিতে পারি, যাতে তারা চিকিৎসকদের যেকোনো সংকটের ক্ষেত্রে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে পারেন কারণ আমরা জানি না আমাদের কতজন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবেন এবং প্রাণঘাতী এ ভাইরাস আর কতদিন থাকবে,’ যোগ করেন বিএমএ সভাপতি।